কৃষিকথার ৭৫ বছর পদার্পণে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করছি যিনি যারা এর নামকরণ করেছেন, এর প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী হয়েছেন ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষ হিসেবে নাম লিখিয়েছে সেসব বিশুদ্ধ মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অভিনন্দন আর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার জীবনে কৃষিকথা অন্যরকম প্রেরণা আর মাইলস্টোনের মতো কাজ করছে আজ অবধি। যতটুকু মনে পড়ে আমার জীবনে প্রথম স্পর্শ করা কৃষিকথার প্রথম সংখ্যা ছিল পৌষ ১৩৮৭ সনের সংখ্যাটি। আমি ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরের দিন রাজনৈতিক সমস্যা ও জটিলতার জন্য ১১ মাস ভার্সিটি বন্ধ থাকে। ভার্সিটি খোলার পর একদিন পড়ন্ত বিকেলে নতুন বন্ধুদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির পুরাতন বিল্ডিংয়ের পাশে নদীর ধারে ঘুরতে গেলাম। নদীর কিনারে সাইনবোর্ড কৃষি তথ্য সার্ভিস লেখা একটি অফিস দেখলাম। দুরু দুরু পায়ে অফিসের ভেতরে গেলাম। যে মানুষটির সাথে প্রথম পরিচয় তার নাম জমশেদ আলী (মরহুম)। কথা বললাম। একখান কৃষিকথা কেনার জন্য বলে পুরো বছরের গ্রাহক হওয়ার কথা জানালাম। জমশেদ সাহেব খুব আগ্রহ করে আমার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে আমার আবাসিক ঠিকানা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪১ শহীদ শামসুল হক হলের নামে গ্রাহক ঠিকানায় রসিদ কেটে দিলেন। সে যে কৃষিকথার সাথে আত্মীক বন্ধনের যাত্রা হলো। আমি খুব গর্ব করে বলতে পারি যে আমিই একজন বিশেষ মানুষ যে কৃষিকথার ভালো লাগা থেকে গ্রাহক। পাঠক থেকে লেখক এবং লেখক থেকে জিম্মাদারি মানে কৃষিকথা প্রকাশের আহ্বায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। আমি গর্ব করে বলতে পারি আমার জীবনে কৃষিকথার সময়কালে অন্তত ১০০টির বেশি লেখা কৃষিকথায় স্থান পেয়েছে। এখন কৃষিকথা কার লেখা কি লেখা, কেমন লেখা কখন যাবে তা নির্ধারণ করার মূল দায়িত্ব নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। আর ৭৫ বছরের উদ্বোধনী সংখ্যাও আমার সংশ্লিষ্টতায় প্রকাশিত হচ্ছে এটি আরো বেশি সুখকর বিষয়।
কৃষিকথা আমার জীবনে এ অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। একনিষ্ঠ পাঠক, সুলেখক এবং কৃষিকথা প্রকাশের অভিজ্ঞতা দিয়ে মুনশিয়ানা শিখিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই কৃষিতে সাহিত্য কিংবা সাহিত্যে কৃষির বিগলিত হওয়া কৃষিকথাই আমাকে শিখিয়েছে। আমিও কৃষিকথাকে ধারণ করে লালন করে এসেছি অন্তত ৩৫ বছর ধরে। কৃষিকথার যে সংখ্যা আমার জীবনে সুন্দরের উপমা হিসেবে এসেছে সেটির আঙ্গিক বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়- সেটি ছিল ৪১তম বর্ষের ৯ম সংখ্যা। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ১৯৮১ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত। সে সংখ্যার প্রধান সম্পাদক ছিলেন আ.কা.মু গিয়াস উদ্দীন মিলকী (মরহুম)। যুগ্ম সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, সহযোগিতায় মু. ছমিরুদ্দীন খাঁ (মরহুম) এবং কেবিএম মাহফুজ এলাহী। প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন প্রাণের মানুষ প্রাণেশ কুমার মণ্ডল (প্রয়াত)। সংখ্যাটির মূল্য ছিল ১ টাকা। তখন কৃষিকথার সডাক মাশুল ছিল ১০ টাকা। গ্রাহক হয়েছি বলে জমশেদ সাহেব আমাকে পৌষ সংখ্যাটি বিনে পয়সায় দিয়েছিলেন। আমি তো খুশিতে আটখানা। সে সংখ্যায় যে লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো ছিল ০১. স্বনির্ভরতা অর্জনে আলু চাষ-কামাল উদ্দীন আহমদ (মরহুম), ০২. বীজ বাছাই ও বীজতলায় বীজ বপন- মো. ওয়াজি উল্লাহ, ০৩. শস্যের পর্যায়ক্রম চাষ-মনোয়ার হোসেন, ০৪. গমের রোগ ও তার প্রতিকার-হীরালাল দেবনাথ, ০৫. প্রেষণা- মো. হোসেন ভূঞা, ০৬. এই মন এই মাটি-মীজানুর রহমান শমশেরী, ০৭. ধানের দেশে প্রাণের চাষি-অনীক মাহমুদ, ০৮. বাংলাদেশের মাটি- মো. ইকবাল হোসেন, সমিতি-ওসমান গণি, ০৯. ভেষজ উদ্ভিদ-হোসনে আরা, ১০. বাংলাদেশে ব্যাঙ চাষের সম্ভাবনা-গোলাম কিবরিয়া (মরহুম), ১১. কৃষি প্রশিক্ষায়তন পরিচিতি তাজহাট-একেএম আনোয়ারুল কিবরিয়া (মরহুম), ১২. পচা ডিম পচা মন- মোহাম্মদ মোস্তফা আলী (মরহুম), ১৩. প্রশ্নোত্তর মু. ছমিরুদ্দীন খাঁ (মরহুম), ১৪. লেখক পরিচিতি এবং ১৫. আমাদের কথা। ৩৫৭ থেকে ৪০৪=৪৮ পৃষ্ঠাব্যাপী কৃষিকথাটি আমার জীবনে পড়া এবং লেখা দুটোই অমৃতের মতো স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিল। সংখ্যাটি আজো আমি যতন করে রেখে দিয়েছি। শুধু তাই না বলতেই হয় নিজের সখে এবং নেশায় ১৯৫০ সনের কাছাকাছি সময় থেকে এ যাবৎকালের সব সংখ্যা কৃষিকথা আমার সংরক্ষণে আমার ব্যক্তিগত ভুবনের লাইব্রেরিতে জমা আছে খুব সযতনে।
এরপর থেকে কোনো দিন কৃষিকথা থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। পুরোদস্তুর কৃষিকথার লেখক হিসেবে সম্পৃক্ত হই ১৪০৫ সনের ভাদ্র সংখ্যা থেকে বৃক্ষ ও বন্ধু আমার শিরোনামে। সিলেটে চাকরির সুবাদে কৃষি তথ্য সার্ভিসের আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার হিসেবে লিখেছিলাম সিলেটের বৃক্ষপ্রেমিক আফতাব চৌধুরীকে নিয়ে। এরপর কত লেখা কত বিশ্লেষণ। মনে পড়ে বিশেষ কারণে কোনো এক কার্তিকের সংখ্যা কৃষিকথায় একসাথে আমার ৩টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ মাসের কৃষি নির্দিষ্ট লেখা, বিশেষ লেখা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ফরমায়েশি লেখা মিলে মোট ৩টি। কৃষিকথার ১৪১১ সনের একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ধান সংখ্যা হিসেবে। কত শত সহস্রর প্রশংসা যে পেয়েছি সে সংখ্যা ছাপানোর জন্য, তার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। এত বছর পরেও সে সংখ্যাটি অতি মূল্যবান ধানের তথ্যবহুল সংখ্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। পুরো কৃষিকথা গ্লসি পেপারে সম্পূর্ণ রঙিন ছিল ইরি পেট্রার আর্থিক সহযোগিতায়। মানজুমুল হক, মতিয়ার রহমান, মেজবাহ উদ্দিন এবং আমি এ চারজন মিলে এক সপ্তাহের মধ্যে অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে সংখ্যাটি আলোর মুখ দেখে। সে সংখ্যাটি আজো হাতে নিলে অনন্য সংখ্যা হিসেবে গর্ব অনুভব করি।
কৃষিকথার রিদমই আলাদা। এখানে বৈজ্ঞানিক লেখা যেমন থাকে, গবেষকদের লেখাও থাকে, থাকে সম্প্রসারণবিদদের লেখাও। তাছাড়া যাদের আমরা সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে গণ্য করি তারাও লেখেন। ছাত্র শিক্ষক আমলা এদের লেখাও সম্মানের সাথে ছাপানো হয়। অনেক প্রথিতযশা লেখক কৃষিকথায় লিখে ধন্য করেছেন কৃষিকথাকে। কৃষিকথা অনেকে স্বনামে ধন্য লেখকের লেখা যেমন ছাপিয়েছে তেমনি নবীন আনকোরা লেখককে সুলেখকে পরিণত করেছে। এখানে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক লেখা, সফলতার কাহিনী, সাক্ষাৎকার, প্রশ্নোত্তর, রম্য রচনা, কবিতা, গান, গল্প, কার্টুন, ভ্রমণকাহিনী কিনা ছাপানো হয়েছে পরতে পরতে। অনেকেই অপবাদ দেন কৃষিকথার কোনো মাত্রিক পরিবর্তন হলো না। আসলেই কি তাই? বিনয়ের সাথে বলি সময়, সুযোগ, ক্ষমতা, অজস্র সীমাবদ্ধতা নিয়ে কৃষিকথা আজ ৭৫ বছরে পদার্পণ করেছে। সুবর্ণজয়ন্তী, রজতজয়ন্তী পেরিয়ে হীরকজয়ন্তী পালন করছি। এটি অনেক বড় প্রাপ্তি আর গর্বের বিষয়। এটি আমাদের জন্য কম পাওনার কথা নয়। সে কবেকার কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে ঢাকার ইডেন বিল্ডিং হয়ে ফার্মগেটের খামারবাড়ি ৭৫ বছরের জার্নি সুন্দর সুশীলন নিখুঁত গাঁথা আর হৃদ্দিক বুননের ইতিহাস। আগামী ২০৪০ সালে কোনো একদিন শতবর্ষও পালিত হবে। তখন এখনকার অনেকেই থাকব না। কিন্তু কৃষিকথা থেকে যাবে অনন্তকাল ধরে। প্রকাশিত হবে বহুমাত্রিক ভিন্ন আঙ্গিকে। কৃষিকথা শতায়ু হোক সার্বিকতায় সুন্দরে মোহনীয় আর আকর্ষণীয় লেখালেখিতে মনে প্রাণে এ কামনা থাকল ।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কি? দেখতে হবে বুঝতে হবে শিখতে হবে কাজে লাগিয়ে প্রমাণ করতে হবে। কৃষিকথা তো তাই করছে। খুব সাধারণ সহজ সরলভাবে কঠিনতম বিষয়কে ঝরনার মতো কলকল ধ্বনীতে, মাছের উছলানো শব্দের রিদমে বিলিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসে সবার অনুধাবনের জন্য। শত সহস্র মানুষ কৃষিকথার লেখা পড়ে জেনেছে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করেছে। নিজে সমৃদ্ধ হয়েছে পাশের জনকে অনুপ্রাণিত করেছে। চূড়ান্তভাবে কৃষির সমৃদ্ধি সফলতা সুনিশ্চিত করেছে। কৃষিকথার প্রতিটি আঙ্গিকের লেখা মোহনীয় আকর্ষণীয় জাদুকরী। কেউ লেখা পড়ে কেউবা গল্প পড়ে আবার কেউবা কবিতা পড়ে নিজের ভুবনে বাস্তবায়ন করে সফলতা পেয়েছে। কৃষিকথার মূল গর্বিত অংশ কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি। নতুন পুরনো মিলিয়ে বারবার লেখকের মনকে উদ্যোমী করে তোলে।
আমরা বলি চাষের কথা চাষির কথা পাবেন পড়লে কৃষিকথা। কৃষিকথায় আছে রে ভাই হরেক রকম তথ্য, শস্য, মাছ, হাঁস মুরগি সমন্বিত সত্য। কৃষিকথা কৃষকের কাজের কথা বলে, কৃষকের সফলতার কথা বলে। কৃষকের জন্য আবিষ্কার উদ্ভাবনীর কথা বলে। মোট কথা আপামর কৃষকের চাহিদার কথা ভেবে মৌসুম উপযোগী করণীয় সম্পর্কে তথ্য ও প্রযুক্তি সম্প্রচারের জন্য কৃষিকথা বিভিন্ন আঙ্গিকে তথ্যপ্রযুক্তি সরবরাহ করে। কৃষকদের সুখ দুঃখ বেদনা হাসি কান্না সব কিছুই কোনো না কোনোভাবে কৃষিকথায় স্থান পায়। আর এজন্য ৭৫ বছর ধরে কৃষিকথা কৃষক ও কৃষির প্রধান মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে। কৃষিকথা বিভিন্ন গবেষক বিজ্ঞানী সার্ভিস প্রোভাইডার এবং উদ্যোগী কৃষকদের আসল চাহিদা আবিষ্কার উদ্ভাবনের প্রতি তীক্ষ্ম নজর রাখে। আর সময় উপযোগী করে সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে ছাপার অক্ষরে বিলিয়ে দেয়। ৭৫ বছরের ইতিহাসে কৃষিকথা কৃষি ও কৃষকদের চাহিদা উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির বাইরে যায়নি কখনো। বরং অনেক সমস্যা বাধা পেরিয়ে উন্নয়ন সমৃদ্ধির কথাই বলে গেছে। এক বিন্দুও বিচ্যুৎ হয়নি।
কৃষিকথার বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। আমাদের জরিপ বলে ১টি কৃষিকথা অন্তত ১০ জন পাঠক পড়ে। সে হিসাবে কৃষিকথার পাঠক সংখ্যা ৫ লাখের ওপরে। এ ৫ লাখের ১০% যদি কৃষিকথা ছাপানো তথ্যপ্রযুক্তি নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করে তাহলে হাজার লাখো কৃষকের আঙিনা ফুলে ফলে মসলা আর সবুজ শ্যামলিমায় সুশোভিত হয়ে ভরে উঠে আমাদের বিশ্বাসের শস্যভা-ার। কৃষিকথায় ছাপানো লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে কতশত পাঠক ছুটে এসেছেন ঢাকার খামারবাড়িতে কৃষিকথার সদর দপ্তরে। লেখকের সাথে আরো নিবিড় বিস্তারিত আলাপ আলোচনার জন্য। আমরা হৃদ্দিক সেতুবন্ধনের কাজ করেছি। দুই পক্ষ মিলে নতুনের সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছে এর পরই এবং আপন ভুবনে তার প্রমাণ রেখেছে। কৃষিকথার লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে এক যুবক বস্তা ভরে শাকসবজি নিয়ে খামারবাড়িতে এসেছে, আমাকে ও আমদের দেয়ার জন্য। যুবকের কথা... কৃষিকথার লেখা আর কৌশল মতো আমি চাষ করেছি এবং লাভবান হয়েছি। এগুলো আপনাদের জন্য তোহফা আমার অন্তর থেকে...। ফিরাতে পারিনি যুবককে। একবার আমার একটা গল্প সুবর্ণ গ্রাম পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে এক যুবক ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এসেছেন সে আমার সাথে সুবর্ণ গ্রাম দেখতে যাবে বলে...। আরেকবার হলিসিটি সিলেট থেকে এক যুবক এসেছেন আমার লেখা রকমারি মনোহরি পড়ে রকমারি ফার্মিং কমপ্লেক্সের প্রধান আহসান হাবিব সাজুর সাথে কথা বলতে। কৃষিকথা কথা পড়ে কতজন জিরো থেকে হিরো হয়েছেন তার হিসাব নেই। আমরা তখন খুব গর্ব করি যে কৃষিকথার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে তারা আলোকিত সমৃদ্ধ কৃষি ভুবনের গর্বিত বাসিন্দা হয়েছেন। কৃষিকথা এভাবেই কৃষি উন্নয়নের মূলমন্ত্র বিলিয়ে দিয়ে আপামর সবাইকে মানসিকভাবে পারিপার্শ্বিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে কৃষির প্রতি আগ্রহী করে তোলে অনেক দূরের বাতি ঘরে নিয়ে যায়।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন কৃষিকথা কারা পড়েন? বিনয়ের সাথে বলি সবাই পড়েন। কৃষক যেমন পড়ে ছাত্র, শিক্ষক, উদ্যোগী ব্যবসায়ী, গৃহবধূ কিষাণ বধূ উন্নয়ন কর্মী গবেষক, বিজ্ঞানী, চাকরিজীবী ও বেকার সবাই পড়েন। কৃষি কাজ যদি কৃষি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে বলব কৃষিকথা কৃষি কাজের এক ধারাবাহিক সময়োপযোগী গাইড লাইন, মাইলস্টোন। চলমান বাজারে অনেক ফার্ম ম্যাগাজিন আসে বুক ফুলিয়ে রঙিন হয়ে আবার হারিয়ে যায় মাথা নিচু করে অন্ধকারের অমানিশায়। কৃষিকথা সে যে ৭৪ বছর আগে ১০৪১ সালে যাত্রা করেছিল। হারিয়ে যায়নি থেমে থাকেনি। চলছে আপন মহিমায়। চলবেও আরো বহু দিন ধরে।
ধান উৎপাদনের ট্রেন্ডে সে যে ১ কোটি ১০ লাখ টন থেকে এখন পৌনে ৪ কোটি টনে পৌঁছলে এতে কৃষিকথার কোনো অবদান নেই? ধানের উৎপাদন ৩ গুণেরও বেশি, গম ২ গুণ, সবজি ৫ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ গম ভুট্টাসহ এর পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টন হয়েছে, এখানে কৃষিকথার কোনো ভূমিকা নেই? বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১১ লাখ টন বীজ ব্যবহার হয় তার মধ্যে বিএডিসি সরবরাহ করে মাত্র ধানের ৩৫-৪০ ভাগ এবং অন্যান্য ফসলের ১০-১২ ভাগ এ খানে কৃষিকথার কি কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই? মাছ উৎপাদনে আমরা যে চতুর্থ স্থান দখল করেছি এতে কৃষিকথার কোনো বিনিয়োগ নেই ডিম দুধ পোলট্রি খামার ব্রয়লার মাংসের যে অভাবনীয় অগ্রগতি এতে কৃষিকথার কোনো অবদান নেই? ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কৃষি খামার স্থাপন, সমন্বিত খামার প্রতিষ্ঠা, খামার যান্ত্রিকীকরণ ও সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ এবং এলসিসি, এডব্লিওডি, গুটি ইউরিয়া, মিশ্র সার, হাত পরাগায়ন, আইপিএম, আইসিএম, আইএফএম, ...প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার এখানে কৃষিকথা কী করছে একটু ভাবলেই উত্তর পাওয়া যাবে। আছে আছে অনেক আছে। গ্রামীণ চাষি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা তাদের জিজ্ঞেস করুন কৃষিকথা কী করছে কৃষি উন্নয়নের মূল স্রোতধারায়?। হিসাব কষে দেখলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কৃষিকথা ধীরে নীরবে নিভৃতে কৃষি উন্নয়নে কৃষি শিক্ষায় কৃষি দক্ষতা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখে চলছে।
কৃষিকথা কৃষি উন্নয়নের কোন শাখা বা অংশকে কভার করছে তা তো আমরা সবাই জানি। মাছ ফসল, উদ্যান ফসল, মসলা, ফুল, ফল, বাহারি, মাছ, গবাদিপশু, পশুপাখি, পরিবেশ, পুষ্টি, জলবায়ু আবহাওয়া, এ সময়ের কৃষি, সমসাময়িক কৃষি, কৃষির সমস্যা ও সমাধান সব থাকছে পরতে পরতে। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের সব ক’টি সেক্টরে এমন অভাবনীয় নিরবচ্ছিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সেবা কে-ইবা দিচ্ছে। বিজ্ঞান গবেষণা জরিপ আর সৃষ্টিশীল ভাবনার ফলাফলগুলোকে সহজ সরল বোধগম্য করে প্রকাশ করা হয় আমাদের মূল অভীষ্ট দলের জন্য। তারা পড়ে বুঝে কাজে লাগায় নিজ আঙিনায় আপন ভুবনে। এ তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তবায়নের কারণে কিংবা ফলশ্রুতিতে আশার আলোগুলো শাখা-প্রশাখা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে সবুজ শ্যামল বাংলার সমৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখছে। এ কথা অস্বীকার করব কেমন করে। কৃষিকথা কৃষি উন্নয়নের গাইড লাইন মাইলস্টোন।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষিতে সাফল্য ঈর্ষণীয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রতিনিয়ত কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনুসরণীয় উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ ঊর্ধ্বগতিতে। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে অষ্টম, আম উৎপাদনে নবম... আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, খনিজসমৃদ্ধ ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও উল্লিখিত নামের শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে প্রায় ৭ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। অথচ এখন দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি, পাশাপাশি আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দানাদার ফসলের সাফল্যের সাথে গম ভুট্টা তো আছেই। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বে ধানের গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় ৩ টন, আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। তা ছাড়া ৮৫-৯০ লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। বাংলাদেশ এখন চাল, আলু ও ভুট্টা রফতানি করছে। গত ২৬ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো চাল রফতানি শুরু করে সরকার। এসব ক্ষেত্রে কৃষিকথা কোনো অবদান নেই। আছে আছে অনেক আছে। আমাদের কিছু কঠিন সীমাবদ্ধতার জন্য কৃষিকথা আরো মোহনীয় কার্যকর করতে পারছি না। প্রতিশ্রুতি থাকল আমাদের সাধ্যের সীমানা অতিক্রম করেও আমরা পাঠক কৃষি ও কৃষকের চাহিদার ষোলোকলা পূর্ণ করা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবই। আর বিশুদ্ধভাবে বলি প্রিয়পাঠক এবং সম্মানিত উন্নয়নের মহানায়ক কৃষক আপনারা আমাদের উচ্ছ্বসিত প্রাণের উচ্ছ্বাসের উৎস গর্বের মূলমন্ত্র।
লেখক:
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
* উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, subornoml@gmail.com